বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার স্ত্রীর সম্পত্তি কত?

অনলাইন ডেস্ক | আপডেট: রবিবার, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪

সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার স্ত্রীর সম্পত্তি কত?
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৯ সালে যখন আছাদুজ্জামান মিয়া অবসরে যান তখন তার স্বীকারোক্তি অনুসারে, তিনি প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা সার্ভিস বেনিফিট পেয়েছিলেন। কিন্তু যে পরিমাণ সম্পদ তিনি গড়েছেন তার প্রকৃত চিত্র এর কিছুই নয়। বাস্তবতা হলো সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যরা এর অনেক আগে থেকেই তাদের সম্পদ বাড়িয়ে যাচ্ছিলেন।

আছাদুজ্জামানের পরিবারে তিন সন্তানসহ সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। এই পরিবারের রাজধানীর বসুন্ধরা ও নিকুঞ্জ এলাকায় অন্তত দুটি বহুতল ভবন, ঢাকা মহানগর ও সাভারে অন্তত চারটি ফ্ল্যাট এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর ও ফরিদপুরে অন্তত ২০ একর আবাদি ও অনাবাদি জমি রয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অন্তত দুটি পরিবহন কোম্পানি ও একটি আইটি ফার্মের মালিকানার সিংহভাগ অংশীদার এই পরিবার।

সুনির্দিষ্ট করে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ বলা কঠিন। তবে এই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার পরিবার ও তাদের পাঁচ আত্মীয়ের অন্তত ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চলছে আনুষ্ঠানিক তদন্ত।


তদন্তের ব্যাপারে জানে দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছেন, 'আছাদুজ্জামান, তার স্ত্রী ও তিন সন্তান এবং তাদের সংশ্লিষ্ট আরও পাঁচজনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে আমরা বিভিন্ন দপ্তর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছি।'

গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে ডেইলি স্টার আছাদুজ্জামান মিয়া, তার স্ত্রী ও তিন সন্তান এবং তাদের তিনজন নিকটাত্মীয়ের শত শত পৃষ্ঠার ট্যাক্স ফাইল, জমির দলিল এবং অন্যান্য দাপ্তরিক নথি দেখেছে।

তাদের সাম্প্রতিক আয়কর নথি, জমির দলিল এবং দুটি পরিবহন কোম্পানি, একটি আইটি ফার্ম ও একটি স্বর্ণের দোকানের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আছাদুজ্জামানের পরিবার ও তার নিকটাত্মীয়—এই আটজনের সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি।

আছাদুজ্জামান মিয়া, তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের সাম্প্রতিক আয়কর ফাইলে সম্মিলিত ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৩ কোটি টাকা।

তিন সন্তানের মধ্যে কেবল তাদের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করছেন বলে জানা গেছে। আয়কর পরিশোধ করার পরে তার বার্ষিক বেতন ২৪ লাখ টাকা। অন্য দুজনের মধ্যে ছোট ছেলে আসিফ মাহদীন এখনো যুক্তরাষ্ট্রে পড়ছেন এবং তাদের দ্বিতীয় সন্তান আয়েশা সিদ্দিকা কয়েক বছর আগে ঢাকার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

তাদের সর্বশেষ আয়কর ফাইল অনুযায়ী, এই তিন ভাইবোনের সম্মিলিত সম্পত্তির পরিমাণ আট কোটি ১৭ লাখ টাকা।

গত দুই সপ্তাহ ধরে আছাদুজ্জামান মিয়াকে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি এবং হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমেইলের জবাব দেননি। তবে জুনের শেষের দিকে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে তিনি অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তিনি ইংরেজি দৈনিককে বলেন, 'আমরা আয়কর রিটার্নে আমাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছি।'

দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, এই পরিবার আয়কর ফাইলে তাদের সম্পদের বেশিরভাগ তথ্য গোপন করেছে। বাকিগুলো তাদের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। একের পর এক তারা তাদের সম্পত্তির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য দেখিয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২২-২৩ করবর্ষে আছাদুজ্জামান নিজের নামে ছয় কোটি এক লাখ টাকার সম্পত্তি আছে বলে ঘোষণা দেন। যদিও তিনি দেখিয়েছেন, তার হাতে নগদ এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা আছে, তবে তিনি কোনো ব্যাংক ডিপোজিট দেখাননি।

ডেইলি স্টারের হাতে আসা জমির দলিলে দেখা গেছে, আছাদুজ্জামান তার ছোট ছেলে আসিফ মাহদীনের সঙ্গে যৌথভাবে গাজীপুরের ছোট গোবিন্দপুরে দেড় বিঘা জমি কিনেছেন। কিন্তু তিনি তার আয়কর ফাইলে সেই জমির কথা উল্লেখ করেননি।

আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত হলো—তার আসবাবপত্রের মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। তার বিদ্যুৎ বিল দেখানো হয়েছে ৪০ হাজার ৩৪৮ টাকা বা প্রতি মাসে তিন হাজার ৩৬২ টাকা।

তার স্ত্রী আফরোজা জামান (৫৯) একজন গৃহিনী। ২০২৩-২৪ করবর্ষে তিনি আট কোটি ২৪ লাখ টাকার সম্পত্তির মালিক বলে ঘোষণা দেন। আয়কর রিটার্নে তিনিও তার ব্যাংক ডিপোজিটের তথ্য গোপন করেছেন। যদিও ডেইলি স্টারের কাছে থাকা নথিতে দেখা যায়, চলতি বছরের ৩০ জুন কমপক্ষে দুটি ব্যাংকে তার এক কোটি ৫৪ লাখ টাকার বেশি ছিল।

আফরোজা মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান। এই কোম্পানিতে তার চার হাজার (৪০ শতাংশ) শেয়ার রয়েছে। গুলশান চাকা নামে আরেকটি পরিবহন কোম্পানির পরিচালক তিনি। সেখানে তার দুই হাজার (২৫ শতাংশ) শেয়ার রয়েছে। এসব কিছুই তিনি তার ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ করেননি।


রাজধানীর নিকুঞ্জের এই ট্রিপ্লেক্স বাড়িটির মালিক আছাদুজ্জামান মিয়ার ছোট ছেলে আসিফ মাহদিন। ছবি: স্টার
আসাদুজ্জামানের সম্পদ

২০২২-২৩ সালের আয়কর রিটার্নে সাবেক এই পুলিশ কমিশনার তার জন্মস্থান ফরিদপুরসহ, ঢাকার বাড্ডা, সাভার ও রূপগঞ্জে ১৬ একরের বেশি কৃষিজমি দেখান যার বেশিরভাগ উত্তরাধিকারসূত্রে ও 'হেবা' জমি এবং আবাসিক প্লট হিসেবে দেখানো হয়।

হঠাৎ ২০১৩ সালে তিনি তার দুই বোন এবং অন্য একজন অজ্ঞাতনামা দাতার কাছ থেকে 'হেবা' (উপহার) এর ৬০০ ডেসিমেল বা ছয় একর কৃষিজমি পান। তার কর ফাইল অনুযায়ী 'হেবা' জমি ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি ছাড়া অন্য সব জমির ঘোষিত মূল্য ২ কোটি ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ১৪০ টাকা।

রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর দুটি সূত্র বলছে যে এই সম্পত্তির বর্তমান মূল্য অনেক বেশি। কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি।

১৯৮৮ সালে পুলিশ চাকরিতে যোগ দেওয়া আসাদুজ্জামান মিয়ার সাভারে ৯০ বর্গফুট পার্কিংয়ের পাশাপাশি ১ হাজার ৯১৩ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০২০ সালে অ্যাপার্টমেন্টটি কেনা হয়েছিল এবং তার ট্যাক্স ফাইলে এর মূল্য দেখানো হয়েছে তিন লাখ টাকা, যা প্রতি বর্গফুটে ১৫৬ টাকা।

তার ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে (স্টক, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি) এবং একটি টয়োটা হ্যারিয়ার রয়েছে যার দাম ৬৮ লাখ টাকা।

আফরোজার সম্পদ

আফরোজা তার স্বামীর চেয়ে ধনী।

২০১১ সাল থেকে মাত্র এক দশকে তিনি ঢাকার জোয়ার সাহারা, রূপগঞ্জের পূর্বাচল, গাজীপুর ও ফরিদপুরে একাধিক জমি কিনেছেন, যার সম্মিলিত দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা।

শুধু ২০১৭-২০১৯ সালেই গাজীপুর ও রূপগঞ্জে ২১০ ডেসিমেল জমি কিনেছেন- নিজের নামে ১০০ ও জোবাইদা বিনতে জাফর নামে এক নারীর সঙ্গে মিলে ১১০ ডেসিমেল জমি কেনেন তিনি। এগুলোর মোট দাম দেখানো হয়েছে ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা বা প্রতি ডেসিমেল ১৬ হাজার ৬৫৬ টাকা।

২০২৩-২৪ আয়কর ফাইল অনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ ৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা এক বছর আগে তার স্বামীর মোট সম্পদের চেয়ে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা বেশি।

সে বছর আফরোজার সাউথইস্ট ব্যাংকে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৪২ হাজার ৮১৬ টাকা এবং কৃষি ব্যাংকে ১৫ লাখ ৮ হাজার ৮৪০ টাকা ছিল, কিন্তু তিনি তার ট্যাক্স রিটার্নে তা দেখাননি। ডেইলি স্টারের কাছে দুটি ব্যাংক তার অ্যাকাউন্টের বার্ষিক বিবরণী রয়েছে।

পরিবারের প্রকৃত সম্পত্তি গোপন করতে আফরোজা অন্যান্য কৌশলও কাজে লাগিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে জমির দলিলে ডাকনাম ব্যবহার করা এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বাক্ষর ব্যবহার করা।

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় ২০১৯ সালে একটি জমির দলিলপত্রে তার স্বামীর নাম 'মো. মিন্টু মিয়া' লেখা হয়। স্বজনরা বলছেন, মিন্টু আসাদুজ্জামানের ডাকনাম, তবে সরকারি কাগজপত্রে ডাকনাম ব্যবহারের অনুমতি নেই।

নিজের সম্পত্তি গোপন করার চেষ্টায় তিনি চারটি পৃথক জমির দলিলে নিজেকে 'আলপনা বেগম' (আলপনা তার ডাক নাম) এবং তার স্বামীকে 'মিন্টু মিয়া' বলে পরিচয় দেন। দ্য ডেইলি স্টার চারটি জমিরই দলিল দেখেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় ৩৯ শতক জমি কিনেছেন তিনি। তার সর্বশেষ ট্যাক্স ফাইলে এই জমির কোনো উল্লেখ নেই।

আরও বেশ কিছু জমির দলিলে দেখা যায় তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বাক্ষর ব্যবহার করেছেন, কখনো 'আফরোজা জামান' কখনো 'আফরোজা বেগম' হিসাবে স্বাক্ষর করেছেন। যদিও তার পাসপোর্ট এবং এনআইডি উভয় ক্ষেত্রেই তিনি তার অফিসিয়াল স্বাক্ষর হিসাবে 'আফরোজা জামান' ব্যবহার করেছেন।

0 Comments